কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আন্দোলনরত এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা।

মূল বেতনের ২০ শতাংশ (ন্যূনতম ৩ হাজার টাকা) বাড়িভাড়াসহ তিন দফা দাবিতে টানা চার দিন ধরে রাস্তায় আন্দোলন করছেন বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীরা। কখনো জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনের রাস্তায়, কখনো কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে বা হাইকোর্টের সামনের সড়কে কর্মসূচি পালন করছেন। সর্বশেষ আজ দুপুরের পর দাবি পূরণ করে প্রজ্ঞাপন জারির দাবিতে রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ শাহবাগ মোড় অবরোধ করেন তাঁরা।

যখন ঢাকায় চলছে এমন কর্মসূচি, তখন একই দাবিতে সারা দেশে এমপিওভুক্ত বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্মবিরতিও চলছে। এমন পরিস্থিতিতে শিক্ষাবর্ষের শেষ সময়ে এসে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা ক্ষতির মুখে পড়েছে। আর রাস্তার আন্দোলনে শিক্ষকদের যেমন কষ্ট হচ্ছে, তেমনি সাধারণ মানুষকেও ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে।

তবে এমন পরিস্থিতি চললেও সরকারের পক্ষ থেকে তা নিরসনে এখন পর্যন্ত কার্যকর পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। গত ৩০ সেপ্টেম্বর এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের বাড়িভাড়ার ভাতা মাত্র ৫০০ টাকা বাড়ানোর বিষয়ে অর্থ বিভাগের সম্মতিপত্র প্রকাশের পর শিক্ষকদের মধ্যে ক্ষোভ বেড়েছে। তাঁদের ভাষ্য, এই ‘সামান্য’ ভাতা বৃদ্ধি শিক্ষকদের জন্য লজ্জার। শতাংশের হারে বাড়িভাড়া চাওয়ার পেছনে তাঁদের আরেকটি যুক্তি হলো, এটি করা হলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিশেষ করে পরবর্তী নতুন বেতন স্কেল করার সময় তা স্বাভাবিকভাবেই বাড়বে। এখন শিক্ষক-কর্মচারীদের অন্য দুটি দাবি হলো উভয়ের জন্য চিকিৎসা ভাতা দেড় হাজার টাকা এবং কর্মচারীদের উৎসব ভাতা ৭৫ শতাংশ করা।

কী ভাবছে সরকার:
শিক্ষা মন্ত্রণালয় এখন চায় শতাংশের হিসেবেই বাড়িভাড়ার ভাতা বাড়ানো উচিত। এ জন্য ৫০০ টাকা বাড়ানোর বিষয়ে অর্থ বিভাগের সম্মতিপত্র দিলেও সেটি কার্যকরের বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রশাসনিক আদেশ জারি করেনি। বরং মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সম্ভাব্য চার ধরনের হার ঠিক করে তাতে কত টাকা লাগবে, তার প্রাক্কলন করে অর্থ বিভাগকে দিয়েছে। সেখান থেকে সরকারের সামর্থ্য অনুযায়ী অর্থ বিভাগ যেন এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বাড়িভাড়া বৃদ্ধির বিষয়টি বিবেচনা করে, তার অনুরোধ করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে মিছিল নিয়ে বেলা দুইটায় শিক্ষক–কর্মচারীরা শাহবাগ মোড়ের উদ্দেশে রওনা দেন। পথে শাহবাগের প্রবেশমুখে পুলিশ ব্যারিকেড দিয়ে রাখে। পরে ব্যারিকেড ভেঙে শিক্ষক–কর্মচারীরা শাহবাগ অবরোধ করে অবস্থান নেন
কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে মিছিল নিয়ে বেলা দুইটায় শিক্ষক–কর্মচারীরা শাহবাগ মোড়ের উদ্দেশে রওনা দেন। পথে শাহবাগের প্রবেশমুখে পুলিশ ব্যারিকেড দিয়ে রাখে। পরে ব্যারিকেড ভেঙে শিক্ষক–কর্মচারীরা শাহবাগ অবরোধ করে অবস্থান নেনছবি: প্রথম আলো
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা আজ বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা অর্থ বিভাগের কাছে প্রস্তাব দিয়েছেন। এখন সিদ্ধান্ত দেবে অর্থ বিভাগ।

জানা গেছে, অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ ও অর্থ বিভাগের সচিব মো. খায়েরুজ্জামান মজুমদার বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের বার্ষিক সম্মেলনে অংশ নিতে বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন। ২২ অক্টোবর তাঁদের দেশে ফেরার কথা রয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ দুজন নীতিনির্ধারক দেশে না থাকায় এ বিষয়ে সিদ্ধান্তও নেওয়া যাচ্ছে না বলে সরকারি সূত্রগুলো জানিয়েছে।

আবার, সরকারি পর্যায়ের কেউ কেউ মনে করেন চলতি বছরের বাজেট বাস্তবায়ন চলছে। এখন মূল বেতনের ২০ শতাংশ হারে বাড়িভাড়া বাড়ানো বেশ কঠিন বিষয়। আবার ৫ বা ১০ শতাংশ হারে বাড়ালে আন্দোলনকারী শিক্ষকেরা মানবেন কি না, সেটিও আরেকটি আশঙ্কার বিষয় হিসেবে দেখা হচ্ছে। আবার কেউ কেউ চান এটি পরবর্তী নির্বাচিত সরকার বাস্তবায়ন করুক।

যদিও আন্দোলনকারী শিক্ষকেরা হুমকি দিয়েছেন এবার দাবি আদায় না করে তাঁরা বাড়ি ফিরবেন না। প্রয়োজনে আমরণ অনশন করবেন। বর্তমানে সারা দেশে ছয় লাখের বেশি শিক্ষক-কর্মচারী এমপিওভুক্ত। তাঁরা সরকার থেকে মূল বেতনসহ কিছু ভাতা পান। কিন্তু শিক্ষক-কর্মচারীরা বলে আসছেন তাঁরা যে বেতন-ভাতা পান তা দিয়ে বর্তমান বাজারমূল্যে জীবনসংসার চালানোই তাঁদের জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে।

আজ শাহবাগ মোড়ে অবরোধ কর্মসূচিতে এসেছিলেন ঢাকার উত্তরখান হাইস্কুলের সহকারী শিক্ষক মো. ইসমাইল হোসেন। সেখানেই কথা হয় তাঁর সঙ্গে। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পাস করেছেন। গত বছরের সেপ্টেম্বরে এই স্কুলে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়েছেন। বর্তমানে সর্ব সাকল্যে বেতন পান ১৮ হাজার ৩০০ টাকা। এর মধ্যে মূল বেতন ১৬ হাজার টাকা। বাকিগুলো বিভিন্ন ভাতা। স্কুল থেকে আলাদা কোনো বেতন পান না। এখন এক রুমে (ভাড়া) তিনজন থাকেন। ভাড়া পনেরো হাজার। তাঁকে দিতে হয় পাঁচ হাজার টাকা। বললেন বর্তমান বেতন দিয়ে চলতে কষ্ট হয়। তাঁর সঙ্গে কথা বলার সময়ে পাশে থাকা অন্য একাধিক শিক্ষক বললেন কৃষিশিক্ষাসহ কয়েকটি বিষয়ে বেতন একটু বেশি। কিন্তু সাধারণ বিষয়ের শিক্ষকের শুরুর মূল বেতন ১২ হাজার ৫০০ টাকা।

শিক্ষক–কর্মচারীদের এই অবস্থা থেকে জীবনমান উন্নয়নে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করছেন। এখন বাড়িভাড়া বাড়ানোসহ তিন দফা দাবিতে গত রোববার জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে লাগাতার অবরোধ কর্মসূচি শুরু করেছিলেন এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীরা। এতে সারা দেশ থেকে আসা বিপুলসংখ্যক শিক্ষক-কর্মচারী অংশ নেন। কিন্তু লাঠিপেটা, সাউন্ড গ্রেনেড ও জলকামান থেকে পানি ছুড়ে শিক্ষক-কর্মচারীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয় পুলিশ। পরে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে গিয়ে অবস্থান নেন আন্দোলনকারী শিক্ষক-কর্মচারীরা। সেখানে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারাও সংহতি জানান। এর মধ্যে গতকাল তাঁরা ‌‘মার্চ টু সচিবালয়’ কর্মসূচি শুরু করলেও হাইকোর্টের সামনে পুলিশ আটকে দেয়। আজ শাহবাগ মোড়ে অবস্থান নিয়েছেন।

কত টাকা দরকার:
শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রমতে, প্রথমে শিক্ষা উপদেষ্টা চৌধুরী রফিকুল আবরার (সি আর আবরার) গত ৭ আগস্ট অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদকে আধা সরকারিপত্র দিয়ে এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের বাড়িভাড়া এক হাজার থেকে বাড়িয়ে দুই হাজার টাকা ও চিকিৎসা ভাতা ৫০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে এক হাজার টাকা করার জন্য গত ফেব্রুয়ারিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের করা অনুরোধের কথা মনে করিয়ে দেন। এ ছাড়া কর্মচারীদের উৎসব ভাতা বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তার কথাও উল্লেখ করা হয়। এ জন্য সব মিলিয়ে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে অতিরিক্ত ৭৬৯ কোটি ৩৩ লাখ টাকা প্রয়োজন বলেও আধা সরকারি পত্রে উল্লেখ করা হয়েছিল।

অবশ্য পরে সেখান থেকে সরে আসে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। শতাংশের হারে বাড়িভাড়া বৃদ্ধির বিষয়ে শিক্ষকদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ৫ অক্টোবর বাড়িভাড়া দেওয়ার বিষয়ে অর্থ বিভাগকে আরেকটি অনুরোধপত্র পাঠায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। তাতে উল্লেখ করা হয়, ২০ শতাংশ হারে বাড়িভাড়া দিলে ৩ হাজার ৪০০ কোটি টাকা, ১৫ শতাংশ হারে দিলে ২ হাজার ৪৩৯ কোটি, ১০ শতাংশ হারে দিলে ১ হাজার ৭৬৯ কোটি এবং ৫ শতাংশ হারে দিলে ১ হাজার ৩৭১ কোটি টাকা প্রয়োজন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *