সিলেট প্রতিনিধি: নদীর বুকে সাদাপাথরের স্তর। পাথরের গা ভিজিয়ে বয়ে চলছে ধলাই নদী। সীমান্তের ওপারে সারি সারি পাহাড়। পাহাড়, পাথর আর জলধারার অপূর্ব মিতালি দেখতে প্রতিদিন হাজারো প্রকৃতিপ্রেমী ছুটে আসতেন সিলেটের সাদাপাথর পর্যটনকেন্দ্রে। সেই নয়নাভিরাম সাদাপাথর এখন লুটেররাজ্য। গেল বছরের ৫ আগস্টের পর থেকে শুরু হয় পাথর লুট। সেই লুটের ষোলকলাপূর্ণ হয়েছে সম্প্রতি। ওপারে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আাছে ভারতের মেঘালয় পাহাড় ওপারে বইছে ধলাই। কিন্তু সূর্যের আলোতে চিকচিক করা সেই সাদাপাথর আর নেই। পর্যটনকেন্দ্রটি এখন যেন কঙ্কালসার বিরাণভ‚মি। একবছর ধরে সাদাপাথর লুটের মহোৎসব চললেও প্রশাসন ছিল নিরব। শত কোটি টাকার পাথর লুট হলেও নিজেদের কোন ব্যর্থতা খুঁজে পাচ্ছে না প্রশাসন। লুটপাট সম্পন্নের পর করণীয় ঠিক করতে আজ বুধবার সভা আহŸান করেছে জেলা প্রশাসন। অভিযোগ রয়েছে, সাদাপাথর লুটে ছিল রাজনৈতিক মদদও। লুটপাট, চাঁদাবাজি ও দখলবাজির অভিযোগে সোমবার রাতে উপজেলা বিএনপির সভাপতি সাহাব উদ্দিনের পদ স্থগিত করা হয়েছে।

সিলেটের পর্যটনকেন্দ্রগুলোর মধ্যে অন্যতম সাদাপাথর। ভারতের সীমান্তঘেঁষা সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ভোলাগঞ্জে অবস্থান পর্যটনকেন্দ্রটির। আদালত ও খনিজ সম্পদের নিষেধাজ্ঞায় গেল কয়েক বছর ধরে সাদাপাথর থেকে পাথর উত্তোলন বন্ধ ছিল। গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার দেশ ত্যাগ ও সরকার পতনের পর সারাদেশে আইনশৃঙ্খলা ভেঙে পড়ে। এই সুযোগে সাদাপাথর থেকে কয়েকশ’ কোটি টাকার পাথর লুট হয়। অভিযোগ ওঠে এই লুটে বিএনপির স্থানীয় কতিপয় নেতার মদদ ছিল। এ সংক্রান্ত সংবাদ গণমাধ্যমে প্রকাশ ও পরিবেশবাদীরা সোচ্চার হলে লুটপাট কিছুটা থামে। এর মধ্যে পরিবেশ এবং খনিজসম্পদ উপদেষ্টা সিলেট ঘুরে সকল পর্যটনকেন্দ্র থেকে অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন বন্ধে ব্যবস্থা নিতে প্রশাসনকে নির্দেশ দেন। এরপর কয়েকদিন পাথর ভাঙার মেশিন উচ্ছেদে অভিযান চালায় টাস্কফোর্স। কিন্তু বন্ধ হয়নি পাথর লুট। গেল কয়েকদিন ধরে পাথরখেকোরা ফের বেপরোয়া হয়ে ওঠে। লুটে নেয় সাদাপাথরের সকল পাথর।

সরেজমিনে দেখা গেছে, সাদাপাথর এলাকা এখন পাথরশূণ্য। ধলাই নদীর বুকজুড়ে পাথরখেকোদের খাবলে হাওয়ার চিহ্ন। নদীর তলদেশে জমা হওয়া পাথর লুটের পাশাপাশি মাটির নিচে গভীর গর্ত করেও তারা লুটেছে পাথর। গর্ত আর লুটের চিহ্ন কঙ্কালসার বিরাণভ‚মিতে পরিণত করেছে সাদাপাথর পর্যটনরকেন্দ্রকে। পাথর লুটের কাহিনী সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ার পর ‘হুশ’ ফিরেছে প্রশাসনের। গতকাল সাদাপাথরে বিপুল সংখ্যক পুলিশের অবস্থান দেখা গেছে। যদিও আগের রাতে উপজেলা বিএনপির সভাপতির পদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়ার পর লুটপাটকারীদের খুব কমই দেখা গেছে সাদাপাথর এলাকায়।

এদিকে, পাথর লুটের জন্য প্রশাসন ও কতিপয় রাজনৈতিক নেতার মদদানের অভিযোগ তুলেছেন পরিবেশবাদীরা। সিলেটে কোয়ারি খুলে দেওয়ার দাবিতে ডাকা হয়েছিল পরিবহন ধর্মঘট। সেই ধর্মঘট প্রত্যাহার নিয়ে শ্রমিকদের সাথে প্রশাসনের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় বিভাগীয় কমিশনারের দেওয়া বক্তব্যও নিয়েও নাখোশ ছিলেন পরিবেশবাদীরা। এছাড়া পাথর কোয়ারি খুলে দেওয়ার দাবিতে নগরীতে অনুষ্টিত হয় মিছিল-সমাবেশ ও মানববন্ধন। এসব কর্মসূচিতে বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপি নেতারা অংশ নিয়ে দাবির প্রতি একাত্মতা জানিয়েছেন। পরিবেশবাদীরা মনে করেন, প্রশাসন ও রাজনৈতিক নেতাদের আস্কারা পেয়েই পাথরখেকোরা বেপরোয়া হয়েছে।

পরিবেশবাদী সংগঠন ‘ধরিত্রী রক্ষায় আমরা (ধরা)’ সিলেটের সদস্য সচিব আব্দুল করিম কিম বলেন, ‘পাথর লুটপাট বন্ধে স্থানীয় প্রশাসন সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়েছে। সিলেটের প্রকৃতিবিনাশের দায় এই অথর্ব প্রশাসনের। প্রশাসনের এই ব্যর্থতার মূল কারন শত কোটি টাকার পাথর লুট থেকে আর্থিক সুবিধা লাভ। সাদাপাথর লুটের বিষয়টি পরিবেশবাদীদের পক্ষ থেকে অনেকবার সতর্ক করা হলেও প্রশাসন নিরব থেকেছে।’

সাদাপাথর লুট হলেও এতে প্রশাসনের কোন ব্যর্থতা ছিল না বলে মনে করেন সিলেটের জেলা প্রশাসক শের মাহবুব মুরাদ। তিনি বলেন, ‘সাদাপাথর রক্ষায় প্রশাসনের কোন গাফিলতি ছিল না। লুটপাট বন্ধ এবং নতুন করণীয় নির্ধারণে আগামীকাল (আজ বুধবার) সভা আহবান করা হয়েছে। ওই সভা থেকে স্থানীয় প্রশাসনের ভ‚মিকা কী ছিল এবং লুটপাট বন্ধে আগামীতে কি করা উচিত তা নির্ধারণ করা হবে।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *