কুলাউড়া প্রতিনিধি: কুলাউড়া উপজেলার সাড়ে তিন বছরের সেই প্রতিবন্ধী শিশু গোপাল সাঁওতালের উন্নত চিকিৎসায় এগিয়ে এসেছেন সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজের ব্রেইন, স্নায়ু ও মনোরোগ বিশেষজ্ঞ সহযোগী অধ্যাপক ডাঃ মোহাম্মদ সাঈদ এনাম। বিভিন্ন গণমাধ্যমে শিশু গোপালকে নিয়ে সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পর বিষয়টি দৃষ্টিগোচর হয় বিশেষজ্ঞ এই চিকিৎসকের। গণমাধ্যমকর্মীদের মাধ্যমে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন এই শিশুর চিকিৎসার আগ্রহ প্রকাশ করলে গোপালের পিতা-মাতা প্রথমবারের মতো কোন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হলেন তাদের শিশু সন্তানকে নিয়ে।

মঙ্গলবার ১৭ জুন বিকেলে গণমাধ্যমকর্মীদের উপস্থিতিতে প্রথমবারের মতো কুলাউড়াস্থ চেম্বারে গোপালের চিকিৎসা, রোগ নির্ণয়ে এমআরআইসহ প্রয়োজনীয় পরীক্ষা করার পরামর্শ দেন চিকিৎসক ডাঃ মোহাম্মদ সাঈদ এনাম। এসময় শিশু গোপালকে পর্যবেক্ষণ করে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে কিছু ওষুধ দেন। আগামী রোববার থেকে চিকিৎসক সাঈদ এনামের তত্ত্বাবধানে সিলেট ওসমানী হাসপাতালে শিশু গোপালকে ভর্তি করে মেডিকেল বোর্ডের মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেন এ চিকিৎসক। ডাক্তারের চেম্বারে শিশু গোপালকে নিয়ে উপস্থিত হন যুগান্তর প্রতিনিধি আজিজুল ইসলাম, জনকণ্ঠ প্রতিনিধি সঞ্জয় দেবনাথ, আজকের দর্পণ প্রতিনিধি নাজমুল বারী সোহেল, কালের কণ্ঠ প্রতিনিধি মাহফুজ শাকিল, সমকাল প্রতিনিধি সৈয়দ আশফাক তানভীর, কালবেলা প্রতিনিধি মহি উদ্দিন রিপন, আমাদের সিলেট প্রতিনিধি তারেক হাসান, আধিবাসী নেত্রী ও মানবাধিকার কর্মী ফ্লোরা বাবলী তালাং।

এ বিষয়ে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজের মানসিক রোগ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক কুলাউড়ার কৃতিসন্তান ডাঃ মোহাম্মদ সাঈদ এনাম বলেন, শিশু গোপাল মূলত সেরেব্রাল পালসি রোগে আক্রান্ত। সাধারণত এই ধরণের রোগীরা হাটাচলা করতে পারেনা, বসতে পারেনা, মাথা সোজা করে রাখতে পারেনা এবং এটা অল্প বয়সেই তার বাবা-মা বুঝতে পেরেছেন। সেই সাথে তার আচার-আচরণে সমস্যা থাকবে। এটার অনেক কারণ রয়েছে। জন্মগত হতে পারে আবার বাচ্চার জন্মের সময় যদি মা আঘাত পান অথবা বাচ্চা যখন গর্ভে থাকে তখন মায়ের ঠিকমত খাওয়া-ধাওয়া না হওয়া, পুষ্টি ব্যাহত হয় তাহলে এ সমস্যা হতে পারে। এ রোগের চিকিৎসা নিউরোলজিক্যাল, সাইকিয়াট্রিক এবং ফিজিওথেরাপি। আপাতত তাকে ব্রেইনের পুষ্টির জন্য কিছু ভিটামিন দেয়া হবে।

তিনি বলেন, শিশু গোপালকে যে গর্তে রাখা হয়েছে এটা আসলে ঠিক না। গর্তে রাখলে বাচ্চার অন্যান্য সমস্যা হতে পারে। এটা চিকিৎসার কোন অংশ নয়। শিশুর বাবা-মাকে পরামর্শ দিয়েছি, চেয়ার কিংবা ওয়ার্কার পেলে তারা যেন সেই গর্তটি ভরাট করে দেন। উন্নত চিকিৎসায় সহায়তা করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিশেষজ্ঞ এ চিকিৎসক বলেন, আগামী রোববার সিলেট ওসমানী হাসপাতালে শিশু গোপালকে আমার তত্ত্বাবধানে ভর্তি করে পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা শুরু করবো। এমআরআইসহ কিছু পরীক্ষা করে দেখা হবে তার ব্রেইনে কতটুকু ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। এ ধরণের রোগী শতভাগ সুস্থ হবে বলে নিশ্চিত করা যাবে না তবে আমরা এমন একটা ব্যবস্থায় তাকে নিয়ে যেতে চাই যাতে সে তার প্রয়োজনীয়তা বুঝতে পারে, সে চলতে পারে সে সম্পূর্ণ সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা কম।

সেরেব্রাল পালসি রোগীদের সচেতনতা নিয়ে ডাঃ সাঈদ এনাম পরামর্শ দিয়ে বলেন, এ ধরণের রোগীর মাকে গর্ভাবস্থায় মায়ের পরিচর্যা, পুষ্টি নিশ্চিত করা, মা যাতে কোন প্রকার আঘাতপ্রাপ্ত না হয় সেটা দেখা। গর্ভের সময় তাকে প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে হাসপাতাল, কমিউনিটি ক্লিনিক বা বিশেষজ্ঞ ধাত্রী দিয়ে ডেলিভারি করতে হবে। গর্ভের সময় এবং গর্ভ পরবর্তী সময় এ সমস্ত বিষয়গুলো খেয়াল করতে হবে।

এরআগে শিশু গোপালের পাশে দাঁড়িয়েছে জেলা ও উপজেলা প্রশাসন। ১৬ জুন সোমবার বিকেলে মুরইছড়া চা বাগানের বাসিন্দা অনিল সাঁওতাল ও সনচড়িয়া সাঁওতালের একমাত্র শিশু সন্তান গোপালকে উপজেলা সমাজসেবা অফিসের মাধ্যমে এক দিনের মধ্যে সুবর্ণ নাগরিক কার্ডের ব্যবস্থা করে সরেজমিনে বাড়িতে গিয়ে সেই কার্ড গোপালের পিতা-মাতার কাছে তুলে দেন ইউএনও মো: মহিউদ্দিন।

শিশু গোপাল সাঁওতালের বাবা অনিল সাঁওতাল ও মা সনচড়িয়া সাঁওতাল বলেন, ‘এত দিন কেউ পাশে দাঁড়ায়নি, প্রথমবারের মতো কোন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে এসে আমাদের বাচ্চার চিকিৎসা করাচ্ছি। অর্থের অভাবে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা উপকরণ কিনতে পারিনি এবং ভালো ডাক্তার দেখাতে পারিনি। তাই বাধ্য হয়ে ঘরের মেঝেতে গর্ত করে শিশু গোপালকে রেখেছি। বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হলে প্রশাসনসহ অনেকেই আমাদের পাশে এসে দাঁড়াচ্ছেন। সহযোগিতার আশ^াস দিয়েছেন। সাড়ে তিন বছরে যেটা সম্ভব হয়নি সেই জন্মনিবন্ধন তৈরি করে প্রতিবন্ধি ভাতার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন ইউএনও স্যার। সর্বশেষ গোপালের চিকিৎসায় এগিয়ে এলেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সাঈদ এনাম।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো: মহিউদ্দিন বলেন, এখন থেকে নিয়মিত ভিত্তিতে সরকারি প্রতিবন্ধী ভাতা প্রাপ্ত হবে শিশুটি। এছাড়া শিশুটির চিকিৎসার বিষয়ে পরিবারটিকে সার্বিক ব্যবস্থার কথা জানানো হয়। শীঘ্রই জেলা প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্র থেকে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা উপকরণ প্রদান এবং বিনামূল্যে চিকিৎসা কার্যক্রম শুরু হবে। শিশু গোপালের চিকিৎসা শেষ না হওয়া পর্যন্ত উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে খোঁজখবর রাখা হবে। তিনি আরো বলেন, শিশুটির জন্মনিবন্ধন এবং মায়ের প্রয়োজনীয় জন্মনিবন্ধন না থাকায় প্রথমে কিছু জটিলতা থাকলেও দ্রুততার সঙ্গে তা সমাধান করা হয়।

উল্লেখ্য, কুলাউড়া উপজেলার কর্মধা ইউনিয়নের সীমান্তবর্তী মুরইছড়া চা বাগানের শ্রমিক অনিল সাঁওতাল ও গৃহিণী সনচড়িয়া সাঁওতালের একমাত্র সন্তান গোপাল জন্ম থেকেই শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধী। শিশুটি স্বাভাবিকভাবে দাঁড়াতে বা বসতে পারে না। দীর্ঘদিন ধরে কোনো চিকিৎসা না পেয়ে, মাটিতে আড়াই ফুট গভীর গর্ত করে সেখানে গোপালকে দাঁড় করিয়ে রাখেন মা। তার কান্না থামাতে ও খাবার খাওয়াতে এভাবে সন্তানকে রাখতে বাধ্য হন তিনি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *