ধেয়ে আসছে ঘূর্ণিঝড় ‘দানা’, উপকূলের ১৪ জেলায় জলোচ্ছাসের আশঙ্কা
ঘূর্ণিঝড় ‘দানা’র প্রভাবে দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে নোয়াখালীর দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ার সঙ্গে জেলা সদরসহ সারা দেশের নৌ যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে
দুর্বার সংবাদ ডেস্ক: ধেয়ে আসছে বঙ্গোপসাগর ও আশপাশের এলাকার গভীর নিম্নচাপের কারণে সৃষ্টি হওয়ায় ঘূর্ণিঝড় ‘দানা’। এটি ক্রমশ স্থলভাগের দিকে এগোচ্ছে বলে আবহাওয়া অধিদপ্তরের সূত্রে জানা যায়। প্রভাবে এরই মধ্যে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের উপকূলীয় বিভিন্ন এলাকার আকাশ মেঘাচ্ছন্ন এবং কোথাও কোথাও গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির খবর পাওয়া গেছে। বুধবার ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ভারী বৃষ্টিপাতও হয়েছে। জানা গেছে, পূর্ব মধ্য বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন এলাকায় অবস্থানরত গভীর নিম্নচাপটি আরও পশ্চিম-উত্তর পশ্চিম দিকে অগ্রসর হয়ে একই এলাকায় অবস্থান করছে। এর কিছুটা প্রভাব উপকূলীয় এলাকা পটুয়াখালীর বিভিন্ন এলাকায় দেখা যাচ্ছে। গতকাল বুধবার আবহাওয়া অফিসের দেওয়া তথ্য মতে, মোংলা সমুদ্রবন্দর থেকে ৬৯৫ কি.মি. দক্ষিণ-দক্ষিণপূর্বে এবং পায়রা সমুদ্রবন্দর থেকে ৬৪৫ কি.মি. দক্ষিণ-দক্ষিণপূর্বে অবস্থান করছিল। এটি আরও পশ্চিম-উত্তরপশ্চিম দিকে অগ্রসর ও ঘণীভূত হতে পারে বলে জানায় আবহাওয়া অফিস। ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের ৫৪ কি.মি. এর মধ্যে বাতাসের একটানা সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ৬২ কি.মি. যা দমকা অথবা ঝোড়ো হাওয়ার আকারে ঘণ্টায় ৮৮ কি.মি. পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের নিকটবর্তী এলাকায় সাগর খুবই উত্তাল রয়েছে।
গভীর নিম্নচাপের প্রভাবে পটুয়াখালীর কুয়াকাটা সংলগ্ন বঙ্গোপসাগর কিছুটা উত্তাল রয়েছে। আকাশ ঘন মেঘাচ্ছন্ন রয়েছে। উপকূলের অনেক স্থানে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিপাত হচ্ছে। বাতাসের চাপ কিছুটা বেড়েছে। নদ-নদীর পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়েছে। গভীর নিম্নচাপের প্রভাবে উপকূলে ঝোড়ো হাওয়া বয়ে যেতে পারে। কুয়াকাটায় আগত পর্যটকদের সতর্ক করছে ট্যুরিস্ট পুলিশ। চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দরকে ২ নম্বর দূরবর্তী সতর্ক সংকেত নামিয়ে ৩ নম্বর দূরবর্তী হুঁশিয়ারি সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে। উত্তর বঙ্গোপসাগর ও গভীর সাগরে অবস্থানরত সব মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতে বলা হয়েছে।উত্তর বঙ্গোপসাগর ও গভীর সাগরে অবস্থানরত সব মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত উপকূলের কাছাকাছি থেকে সাবধানে চলাচল করতে বলা হয়েছে, যেন স্বল্প সময়ের নোটিশে নিরাপদ আশ্রয় যেতে-পারে।
এদিকে ঝড়ের প্রভাবে সাতক্ষীরা, সুন্দরবন, পাবনা, লক্ষ্মীপুর, পটুয়াখালী, কক্সবাজারের টেকনাফ-সেন্ট মার্টিনসহ উপকূলীয় এলাকায় গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি শুরু হয়েছে। লক্ষ্মীপুর-ভোলা-বরিশাল এবং টেকনাফ-সেন্ট মার্টিন রুটে নৌযান চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে। অনেক জায়গায় সকাল থেকে আকাশ মেঘাচ্ছন্ন ছিল। বিকেল থেকে ঝোড়ো হওয়া শুরু হয়। ঘূর্ণিঝড় ‘দানা’র বর্তমান গতিপ্রকৃতি অনুসারে আবহাওয়াবিদদের মতে, এটি আছড়ে পড়তে পারে ভারতের ওড়িশা উপকূলে। এর প্রভাব পড়তে পারে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের উপকূলীয় জেলা খুলনা ও বরিশালের বিভিন্ন এলাকায়। তবে তা এখনই নিশ্চিত করে বলার সময় আসেনি বলে জানিয়েছেন আবহাওয়াবিদরা।আবহাওয়া অধিদপ্তর জানায়, আজ বৃহস্পতিবার রংপুর, রাজশাহী, ঢাকা, ময়মনসিংহ, খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের অনেক জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা বা ঝোড়ো হাওয়াসহ বৃষ্টি ও বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। সেই সঙ্গে দেশের কোথাও কোথও মাঝারি ধরনের ভারী বর্ষণ হতে পারে।
এ ছাড়া আগামীকাল শুক্রবার খুলনা ও রাজশাহী বিভাগের অনেক জায়গায় এবং রংপুর, রাজশাহী, ঢাকা, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের কিছু কিছু জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা বা ঝোড়ো হাওয়াসহ বৃষ্টি ও বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। সেই সঙ্গে দেশের কোথাও কোথও মাঝারি ধরনের ভারী বর্ষণ হতে পারে। অন্যদিকে ভারতীয় আবহাওয়া অধিদপ্তর জানায়, নিম্নচাপের কারণে গতকাল বুধবার আন্দামানের উপকূলবর্তী এলাকায় ভারী বৃষ্টি হয়েছে। ঘূর্ণিঝড় উড়িষ্যার উপকূলে আগাত হানতে পারে। পশ্চিমবঙ্গের দুই ২৪ পরগনা, কলকাতা, দুই মেদিনীপুর, হাওড়া, হুগলি, ঝাড়গ্রাম এবং বাঁকুড়ায় বিক্ষিপ্তভাবে ভারী বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। বৃহস্পতিবার থেকে ওড়িশা এবং পশ্চিমবঙ্গের এই সব জেলায় বৃষ্টির পরিমাণ বাড়বে।
হাতিয়ায় নৌ চলাচল বন্ধ
দৈনিক বাংলার নোয়াখালী প্রতিনিধির তথ্যমতে, ঘূর্ণিঝড় ‘দানা’র প্রভাবে দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে নোয়াখালীর দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ার সঙ্গে জেলা সদরসহ সারা দেশের নৌ যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। বুধবার দুপুরে উপজেলা প্রশাসনের নির্দেশে সব ধরনের নৌযান চলাচল বন্ধের ঘোষণা করা হয়। হাতিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মিল্টন চাকমা বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, ৩ নম্বর হুশিয়ারি সংকেত চলার সাথে সাথে নৌ যোগাযোগ বন্ধ রাখতে বলা আছে। একইসঙ্গে মাছ ধরার নৌকাগুলোকে সতর্কতার সঙ্গে চলতে বলা হয়েছে। অপরদিকে, ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে বুধবার ভোর থেকে নোয়াখালীর বিভিন্ন এলাকায় হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টিপাত শুরু হয়। তবে দুপুর থেকে বৃষ্টিপাত বন্ধ হয়ে যায়। জেলা আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় জেলাতে ২০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। তবে ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কিছুটা বাড়তে পারে। এ কারণে ৩ নম্বর দূরবর্তী হুঁশিয়ারি সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে।
সাতক্ষীরায় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির সভা
সাতক্ষীরা প্রতিনিধি জানায়, ঘূর্ণিঝড় ‘দানা’ উপলক্ষে জেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। জেলা প্রশাসনের আয়োজনে জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে জেলা প্রশাসক মোস্তাক আহমেদের সভাপতিত্বে বক্তব্য রাখেন ও উপস্থিত ছিলেন, সেনাবাহিনী কর্মকর্তা মেজর ইসতিয়াক, সাতক্ষীরা সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ মো. আবুল হাশেম,অতি. পুলিশ সুপার ও সদর সার্কেল মীর আসাদুজ্জামান,স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ-পরিচালক মাসরুবা ফেরদৌস, বিজিবি সহকারী পরিচালক মেজর মাসুদ রানা, সদর উপজেলা নিবার্হী কর্মকর্তা মোঃ শোইয়েব আহমেদ, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নিবার্হী প্রকৌশলী মো. সহিদুল ইসলাম, জেলা তথ্য অফিসার মোঃ জাহারুল ইসলাম, সুশীলনের উপপরিচালক জি এম মনিরুজ্জামান । সমাপনী বক্তব্যে জেলা প্রশাসক মোস্তাক আহমদ বলেন, ঘূর্ণিঝড় ‘দানা’ প্রস্তুতি লক্ষ্যে সকল অফিসে ২ দিন ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। এখান থেকে অ্যাম্বুলেস ব্যবস্থা থাকবে। পর্যাপ্ত পরিমাণে সুকনা খাবার রয়েছে। সকল সাইক্লোন শেল্টার প্রস্তুত করা হয়েছে। এনজিও কর্মীর পাশাপাশি সিপিবি সদস্যরা মাঠে থাকবে। জেলা প্রশাসক সম্মেলন কক্ষে মিডিয়া সেল খোলা থাকবে।
মোংলায় জেটিতে নিরাপদে নোঙর নৌবাহিনীর দুইটি যুদ্ধজাহাজ
মোংলা (বাগেরহাট) প্রতিনিধি জানায়, ঘূর্ণিঝড় দানার প্রভাবে মোংলা বন্দরে নিরাপদে নোঙর করেছে নৌবাহিনীর দুইটি যুদ্ধজাহাজ। বুধবার দুপুরে বন্দরের ৯ নম্বর জেটিতে বিএনএস শাপলা ও বিএনএস শৈবাল নামে জাহাজ দুইটি নোঙর করে। এ ছাড়া বিএনএস প্রত্যাশা ও বিএনএস স্বাধীনতা নামে আরও দুইটি যুদ্ধ জাহাজ মোংলা নৌ ঘাঁটিতে নিরাপদে নোঙ্গর করেছে। এই চারটি জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দর থেকে মোংলায় আসে। মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের হারবার মাস্টার কমান্ডার সাইফুর রহমান ভূইয়া জানান, ঘূর্ণিঝড় দানার প্রভাবে মোংলা সমুদ্র বন্দরে ৩নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত দেখিয়ে যেতে বলেছে আবহাওয়া অফিস। এর ফলে মোংলা বন্দরে নিজস্ব এলার্ট- ওয়ান জারি করা হয়েছে। এছাড়া ঝড় মোকাবিলায় বন্দর কর্তৃপক্ষ সব রকম প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে। মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল শাহীন রহমানের সভাপতিত্বে বুধবার দুপুরে এক সভায় এই প্রস্তুতি গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সভায় বন্দরে অবস্থানরত সকল দেশি-বিদেশি বাণিজ্যিক জাহাজসহ বন্দরের নিজস্ব নৌযানগুলোকে নিরাপদে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। তবে বন্দরে অবস্থানরত আটটি জাহাজে সার, কয়লা ও ক্লিংকারসহ বেশ কয়েক প্রকার পণ্য খালাস বোঝাই স্বাভাবিক রয়েছে বলেও জানায় হারবার মাষ্টার কমান্ডার সাইফুর রহমান ভূইয়া।